মুক্তমত
আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার
ঢাকা কলেজ ১৮৪১ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখানে ইন্টার, পাস কোর্স, অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি ছিলো। বাংলাদেশে প্রথম আইন বিষয় ডিগ্রি এ ঢাকা কলেজেই ছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সরকারি-বেসরকারি অন্য কোনো কলেজেই ছিলো না। ঢাকা কলেজ এ উপমহাদেশের ১০ম প্রাচীন কলেজ বলে স্বীকৃত। পূর্ব বাংলা হাতোগোনা কিছু স্কুল ছিল, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেট্রিকুলেশন পাস করে ইন্টার-সহ উচ্চ শিক্ষার জন্য কোলকাতা যেতে হতো। সাধারণত জমিদার শ্রেণি ছাড়া এটি অন্যদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এসব বিবেচনায় ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ৮০ বছর পর ১৯২১ সালে এ বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ স্হাপিত। যে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি ১০০ বছর পূর্তি উদযাপন করে। আর ঢাকা কলেজের বয়স ১৮৪ বছর। ইডেন কলেজের বয়স ১৫২ (১৮৭৩)। ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের বয়স ১৫১ বছর (১৮৭৪)। শিক্ষা বলেন আর উচ্চ শিক্ষা বলেন, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান চিন্তা করুন।
কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হল ঢাকা কলেজের নিজস্ব ভবন ও হল ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গেলো, মানে যাযাবর হলো। শিক্ষা ভবন হতে বঙ্গবাজার রোড এখনও “কলেজ রোড” নামে পরিচিত, কালের সাক্ষী। ঢাকা কলেজ লাইব্রেরির মূল্যবান ও বিরল সংগ্রহের ২৫ হাজার বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হলো। ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের বড় একটি সংখ্যা পর্যন্ত ধার দেওয়া হলো। তারা লিয়েনে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
ঢাকা কলেজে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টার, পাস কোর্স ও অনার্স -মাস্টার্স পড়ানো হতো। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের লোভে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ভর্তি হতে চাইবে না, তাই ঢাকা কলেজে পাস কোর্স ও অনার্স-মাস্টার্স ভর্তি বন্ধ করে শুধু ইন্টার চালু থাকলো। যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার পাস ছাত্র সরবরাহ করা যায়। অথচ আশ্চর্য হবেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরনিকায় এসব সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকার সরকারি ৭ কলেজের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ৭টি ক্যাম্পাস মিলে ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা কলেজকে কেনো সবসময় বিসর্জন বা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে?
১। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, বিশ্বের বৃহত্তম ‘আদমজী জুটমিল’ বন্ধ হলো। বেতন-বোনাস দাবি বা অনিয়মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হাজার হাজার শ্রমিক চিড়া-মুড়ি নিয়ে ঢাকা অভিযান বা কাঁচপুর ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে অবরোধ করতো, বিশেষ করে ঈদের সময়। সব রাজনৈতিক দল এটিকে হুমকি মনে করতো। এসব কারণ আর নানান বোঝাপড়ায় নীরবে এটি বন্ধ হয়ে গেলো। তেমন প্রতিবাদ হয়নি বললেই চলে।
সরকারের ইচ্ছেয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মতিতে ঢাকার সরকারি ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল বিভাগের সকল সরকারি/বেসরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিলো। এখনো বেসরকারি শতাধিক প্রতিষ্ঠান এর অধিভুক্ত। তাহলে সরকারি ৭ কলেজের সমস্যা কোথায়?
প্রধান সমস্যা আদমজীর মতো হুমকি-
* সরকারি ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার রুটিন, দ্রুত ফলাফল, অন্যায্য ফি প্রত্যাহার, কর্মচারীদের অসহযোগিতা এসবের প্রতিবাদে মাঝেমধ্যে ভিসি ও প্রোভিসি অফিস ঘেরাও করে;
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অভ্যন্তরীণ সিটি কর্পোরেশন এর রাস্তায় বাইরের গাড়ি চলাচল বন্ধ করলে যানযটে নাকাল হয় ঢাকাবাসী। ঢাকার সরকারি ৭ কলেজ এর প্রতিবাদে ৭ কলেজের সামনের রাস্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারবার তাদের সিদ্ধান্ত হতে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু ৭ কলেজ যদি ক্যাম্পাস ভিত্তিক এক ইউনিট হয়, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো সুদৃঢ় হবে। সরকার বলেন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, নিঃসন্দেহে সবসময় হুমকিতে থাকতে হবে।
* বেশ কয়েকবার ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মারামারি হয়েছে;
*ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (আওয়ামী ও বিরোধী) একাংশের ধারণা, ৭ কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি তৎকালীন ভিসি আরেফিন সাহেবের (অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিক) ইচ্ছেয় হয়েছে, এর বিরোধিতা করতে হবে। যদিও আরেফিন সাহেবের সময়কালে ও উনার সম্মতি অধিভুক্তি হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক ও মিডিয়ার প্রচারের কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে দেশের সকল সরকারি কলেজ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আর প্রাইভেট সকল কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাখার নির্দেশনা দেন। এটি বাস্তবায়নে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আজাদ চৌধুরীর সাথে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা অ্যাসোসিয়েশন-এর সভা হয়। অ্যাসোসিয়েশন-এর তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক নাসরীন বেগম ও মহাসচিব আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার (আমি)-সহ একটি প্রতিনিধি দলের সভায় সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও বাস্তবায়ন কমিটির ৬ জন ভিসি’র সাথে আমাদের সভাপতি ও মহাসচিবকে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া আমরা সম্মত হইনি।
* সরকারি ৭ কলেজের দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর ভর্তি ও পরীক্ষার লাভজনক কাজকর্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এর বাইরের বড় একটি অংশ ৭ কলেজের অধিভুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
* প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার সহ শতশত আত্নীয়-স্বজন ও দলীয় শিক্ষক আর কর্মচারি নিয়োগদানের সুযোগ হবে;
* পুরো ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে, এতে সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার সহজ হবে;
* ঢাকার সরকারি ৭ কলেজে ২ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হলে এটি নেমে আসবে ৪/৫ হাজারে। তাহলে এ দুই লক্ষ শিক্ষার্থী কোথায় পড়বে? গড়ে উঠবে নতুন নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামের মুটে-মজুর, কৃষক আর সাধারণের ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার আকাঙ্খা সংকুচিত করার একটি সুক্ষ্ম কৌশল।
* ব্যবসা ছাড়াও নতুন গড়ে ওঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, ডিন, চেয়ারম্যান সহ নানান পদ সৃষ্টি হবে। কর্মরতদের জন্য পার্টটাইম আর অবসরপ্রাপ্তদের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হবে।
* আর এসব কলেজে ইন্টার বন্ধ করতে পারলে কলেজ ব্যবসায় আরও রমরমা হবে।
ঢাকার সরকারি ৭ কলেজের বর্তমান কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৭ কলেজ বিলুপ্তিতে বেশ ভূমিকা রাখছে। আবার অন্তবর্তী সরকারের ওপর ভর করে বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকজন শিক্ষক সাধু সেজে এটি ত্বরান্বিত করতে প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় মিথ্যে ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্বলিত লেখা ছাপছে। একজনতো আদা-জল খেয়ে নেমেছেন। (উল্লেখ্য, আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)।
লেখক পরিচিতি: আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজ; সাবেক অধ্যক্ষ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ; সাবেক সমন্বয়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজ; সাবেক সভাপতি, বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন; সাবেক সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এনআরবি৩৬৫/কিউএএম/কিউটি
[প্রিয় পাঠক, NRB365-এ আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ ই-মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে: NRB365 News
আরও খবর পড়ুন:
বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভিসা পাবেন কি করে? (ভিডিও-সহ)
অভিবাসী ইস্যুতে নতুন আইন বাতিল করলো ফ্রান্সের সাংবিধানিক কাউন্সিল
ভেঙে ফেলা ৪৫০ বছরের পুরনো স্থাপনার রেপ্লিকা নির্মাণের দাবি
কুয়েতে এটিএম বুথ জালিয়াতি, বাংলাদেশি গ্রেফতার
দেশের প্রথম স্কুলের ১৯০ বছর পূর্তি আজ