Monday
22 September 2025

শেক্সপিয়রের দেশে বইয়ের মেলা, অনুপস্থিত বাংলাদেশ

March 12, 2025

ইউরোপ ডেস্ক (লন্ডন, যুক্তরাজ্য থেকে মোরসালিন মিজান):
বইয়ের পৃথিবী কেমন হতে পারে? মানে, যদি চেহারাটা কল্পনা করা যায়, কেমন হবে সেই চেহারা? এই প্রশ্নের সুন্দর একটি উত্তর হতে পারে দ্য লন্ডন বুক ফেয়ার। বিশাল মেলা ঘুরে চোখ জুড়িয়ে গেছে। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বই। নানান ভাষার সাহিত্য। লেখক কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে মতবিনিময়। লেখালেখির বিষয়ে চিন্তার আদান প্রদান। আরও কত কী! সব দেখে বিনা দ্বিধায় মনে হয়েছে এটা বইয়ের পৃথিবী।

মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বিস্ময়ভরা পৃথিবীর দ্বার খুলে দেয়া হয়েছে। হেমারস্মিথ রোডের সুবিশাল প্রদর্শনী কেন্দ্র অলম্পিয়া লন্ডন এখন লোকে লোকারণ্য। প্রথম দিন সকাল থেকেই একেবারে গমগম করছে।

দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ এবং উল্লেখযোগ্য দুটি বইমেলার মধ্যে দ্য লন্ডন বুক ফেয়ার বা এলবিএফ অন্যতম। মেলাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইংরেজি সাহিত্যের তীর্থভূমি লন্ডনে। জগদ্বিখ্যাত বহু লেখক কবি নাট্যকারের জন্ম দিয়েছে লন্ডন। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাম তো আসবেই। চার্লস ডিকেন্স, জন মিল্টন, লর্ড বায়রন, আগাথা ক্রিস্টি বা জন কিটসের মতো আছেন আরও অনেকে। শার্লক হোমসও পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত পঠিত হচ্ছেন। বর্তমান সময়ের বিখ্যাত নামটি জে কে রাউলিং। হ্যারি পর্টারের তুমুল আলোচিত এই লেখিকাও লন্ডনের বাসিন্দা। তো, এইসব অত্যুজ্জ্বল লেখক, কবি, নাট্যকারের দেশে, বইপ্রিয় মানুষের দেশে বইমেলা আলাদা তাৎপর্যের হবে, এটাই স্বাভাবিক। ইংরেজি সাহিত্য যেমন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, তেমনি বইমেলার ক্ষেত্রে বিশেষ একটি স্থান দখল করে আছে লন্ডন বইমেলা।

লন্ডন বইমেলা আমাদের দেশের বইমেলার মতো নয়। সরাসরি বই কেনা বেচার বিষয়টিকে এ ধরনের আন্তর্জাতিক মেলায় তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। এটি বইকেন্দ্রিক বাণিজ্য মেলা। বই-বাণিজ্য সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক মিটিংপ্লেস হিসেবে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহৃত হয়।

প্রতিবারের মতো এবারও পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকে বই সংশ্লিষ্ট মানুষেরা মেলায় এসেছেন। খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। প্রকাশকরাও ভীষণ সক্রিয়। পাশাপাশি নামকরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, গ্রন্থাগারিক, বাণিজ্যিক এবং পেশাদার সংঘ সমিতির কর্তাব্যক্তিরা যোগ দিয়েছেন। সফটওয়্যার, মাল্টিমিডিয়া, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, কনটেইন্ট প্রোভাইডাররা অংশগ্রহণ করেছেন। সম্পাদক, ইলাস্ট্রেটর, অনুবাদক, ব্র্যান্ড লাইসেন্সিং কোম্পানি, অডিও প্রোভাইডার, ডিস্ট্রিবিউটর, চলচ্চিত্র প্রযোজক- কে নেই! ফলে স্রেফ বইমেলা এটিকে বলা যাবে না, তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু।

অলিম্পিয়া লন্ডনের ভেতরে কয়েকটি মস্ত বড় হল। গ্র্যান্ড হল। সবগুলোতে বইয়ের স্ট্যান্ড এবং প্যাভিলিয়ন। মেলার পরিচালক অ্যাডাম রিজওয়ে জানিয়েছেন, এবার মোট অংশগ্রহণকারী ৩০ হাজারের বেশি। এক্সিবিটরের সংখ্যা ৮৪৫। বইমেলায় অংশ নেয়া দেশের সংখ্যাও শতাধিক। শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, ভারত, তুরস্ক, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন। মেলায় চীনের বিশেষ উপস্থাপনা চোখে পড়েছে। ১৯টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলাদা একটি প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে তারা। ‘সামওয়ান টু টক টু’ উপন্যাসের জন্য ব্যাপক প্রশংসিত লেখক লিউ ঝেনইউনকে দেখা গেছে প্যাভিলিয়নে। ভারতও নিজেদের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চেষ্টা করছে জোরেসোরেই। এমনকি সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেকগুলো দেশ বিশাল প্যাভিলিয়ন নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের নাম গন্ধও নেই।

লন্ডন বইমেলায় কাগজে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি আছে অডিওবুক। অডিওবুক নিয়ে একটি অডিও ভিলেজ গড়ে তোলা হয়েছে। হাচেট অডিওর প্রেসিডেন্ট ও প্রকাশক আনা মারিয়া অ্যালেসি এক আলোচনায় অংশ নিয়ে অডিওবুকের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন এর ভবিষ্যত সম্ভাবনা অনেক।

এবারের মেলায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা এইআই। এআই নিয়ে দুনিয়াজুড়ে হৈচৈ এখন। প্রকাশনা শিল্পেও এর ব্যবহার বাড়ছে। লন্ডন বইমেলায় এসে সবচেয়ে অবাক হলাম মার্কিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা স্টোরিটেল সম্পর্কে জেনে, সম্প্রতি এআই দিয়ে তারা একটি বইও লিখিয়ে নিয়েছে! বইটি প্রকাশ করে তুমুল আলোচনায় এখন তারা। প্রকাশনা শিল্পে এআই প্রযুক্তির আরও নানান ব্যবহার এবং সম্ভাবনা নিয়ে মেলায় আলোচনা হচ্ছে প্রতিদিন। মেলার মূলমঞ্চে যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এআই এবং কপিরাইট নীতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বক্তা হিসেবে ছিলেন মার্কিন পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড প্রধান নির্বাহী মারিয়া পালান্তে ও যুক্তরাজ্যের পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী ড্যান কনওয়ে।

লন্ডনে পা রাখার পর থেকেই দেখছি ট্রেনে, বাসে বা পার্কে বসে দেদার বই পড়ে মানুষ। তারপরও বইমেলার আয়োজকরা শঙ্কিত। তারা বলছেন, বইয়ের শহর লন্ডনেও পাঠাভ্যাস আগের তুলনায় কমেছে। তরুণরা বই কম পড়ছে। ফলে পাঠাভ্যাস বাড়ানোর কথা ভাবতে হচ্ছে তাদের। তরুণ যুবাদের বই পাঠে উৎসাহিত করার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে মেলা কর্তৃপক্ষ। রিজওয়ে বলছেন, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে তরুণরা আগের মতো বই পড়ছেন না। তারা কনটেইন্ট যতোটা গ্রহণ করছেন, বই থেকে ততটা নয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এলবিএফ নতুন একটি কর্মসূচী চালু করেছে। ‘পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের বিকাশ’ শীর্ষক অধিবেশনে এ বিষয়ে কথা বলেছেন লেখক উইল রেইফেট হান্টার এবং টেলর-ডিওর রাম্বল।
লন্ডন বইমেলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সেশন সেমিনার। কত রকমের বিষয় নিয়ে সেমিনার হতে পারে তা মেলায় যোগ না দিলে অনুমানই করতে পারতাম না। মেলার দ্বিতীয় দিন বুধবারে বিশেষ আকর্ষণ হয়ে মেলায় এসেছিলেন বাংলাদেশী বংশদ্ভুত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী। তার কথা শোনার জন্য বিপুল সংখ্যক ভক্ত-শ্রোতা সমবেত হয়েছিলেন। আলাদা সেশনে কথা বলার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন আর্জেন্টিনার উপন্যাসিক ক্লাউডিয়া পিনেইরো এবং ওয়াটারস্টোনস চিলড্রেনস লরিয়েট ফ্র্যাঙ্ক কট্রেল-বয়সে।

বই প্রকাশনা বাণিজ্যের নানা দিক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কথা বলছেন হাচেট-এর প্রধান নির্বাহী ডেভিড শেলি, বার্নস অ্যান্ড নোবল এবং ওয়াটারস্টোনসের প্রধান নির্বাহী জেমস ডন্ট। আটলান্টিকের দুই পাশে ব্যবসা পরিচালনার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন তারা।

একই সময়ে চলছে একাডেমিক ও পেশাদার প্রকাশনা সম্মেলন। মেলার পরিচালক রিজওয়ে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাডেমিক প্রকাশনা বাজারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একাডেমিক প্রকাশকরা আর্থিক চাপে আছেন। কারণ প্রকাশনার ধরন বদলাচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে লন্ডন বইমেলা অনুপ্রাণিত করবে বলেও জানান তিনি। সব মিলিয়ে কেমন হচ্ছে এবারের আয়োজন? এমন প্রশ্নে মেলার পরিচালক বললেন, লন্ডন বইমেলা প্রকাশনা স্বত্ব কনটেইন্ট কেনা বেচা চুক্তি স্বাক্ষর এবং এসব নিয়ে আলোচনা করার চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বই ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা আরও এগিয়ে যেতে পারবেন। এটি হলে তারা ভীষণ খুশি হবে বলে জানান তিনি।

তিন দিনব্যাপী মিলনমেলা আগামী কাল বৃহস্পতিবার, মানে ১৩ মার্চ শেষ হবে। এই মিলনমেলার সংবাদ বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্র বা নিউজ পোর্টালে আগে কোনদিন ছাপা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই বাংলাদেশের প্রকাশক পাঠক ও ব্যবসায়ীদের জন্য মেলার ইতিহাসটা ছোট্ট করে হলেও তুলে ধরা আবশ্যক হবে। আয়োজকদের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কালে ১৯৭১ সালে লন্ডন বইমেলার সূচনা। আমাদের অমর একুশে বইমেলার মতো এটিও ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হয়েছিল। লিওনেল লেভেনথাল এই আয়োজনের সূচনা করেন। একটি হোটেলে টেবিল পেতে কিছু বই নিয়ে বসেছিলেন তিনি। হোটেলের নাম ব্যারনেরস। তখন আয়োজনটির নাম ছিল স্পেশালিস্ট পাবলিশার্স এক্সিবিশন ফর লাইব্রেরিয়ানস। লন্ডনে বিপুল সংখ্যক লাইব্রেরি। কয়েক কদম পর পর বইয়ের দোকান। এই মেলা সেই লাইব্রেরিয়ানদের একত্রিত করেছিল। ১৯৭৭ সালে আয়োজনটি দি লন্ডন বুক ফেয়ার নাম ধারন করে। মাঝখানে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হলেও, মেলা এখন স্থির হয়েছে অলিম্পিয়া লন্ডনে। এই স্থায়ী কাঠামোতেই অত্যন্ত গোছালোভাবে প্রতি বছর মেলা আয়োজন করা হয়।
এনআরবি৩৬৫/কিউএএম/আরএম

[প্রিয় পাঠক, NRB365-এ আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ ই-মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]